- দুধে ফরমালিন
- পাম অয়েলের সঙ্গে ডালডা-কাপড়ের রং মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে নামীদামী ব্র্যান্ডের ঘি
- ঘাসের বীজ গুঁড়ো করে ক্ষতিকর রং মিশিয়ে মরিচ, হলুদ
- ঘন চিনি ও স্যাকারিন মিশিয়ে সফট ড্রিঙ্কস
শাহীন
রহমান ॥ রাজধানীর
নবাবপুর রোডের রথখোলা মোড়ে অবস্থিত বৃহত্তম তরল দুধের
আড়ত। আশপাশের
জেলা থেকে প্রতিদিন এখানে দুধ এনে পাইকারি দামে বিক্রি করা
হয়। রমজানে
এ আড়তে দুধের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। অন্যদের সঙ্গে এ আড়তে দুধ
এনে বিক্রি করতেন জহিরুল ইসলাম। মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুধ এনে
তিনি এই হাটে বিক্রি করতেন। স্থানীয়ভাবে দুধ সংগ্রহ করে
রথখোলা মোড়ে আসতে তার সময় লাগে ১০ থেকে
১২ঘণ্টা। সড়ক
ও নৌপথে শীতলীকরণের প্রক্রিয়া ছাড়া ড্রামে ঢাকার
পাইকারি বাজারে নিয়ে আসায় রাস্তায় দুধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দীর্ঘ
সময়েও দুধ যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য দুধে ফরমালিন মেশান Ñজহিরুলের
সহজ-সরল উক্তি।
শুধু
জহিরুল নয়,
এ বাজারে দুধ নিয়ে অধিকাংশ পাইকারি
ব্যবসায়ী একই কাজ করে থাকেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের
কাছে জহিরুল বলেন, মুন্সীগঞ্জ থেকে দুধ নিয়ে তিনি
প্রতিদিন
সন্ধ্যায় এই হাটে আসেন। সকালে দোয়ানো দুধ সন্ধ্যা
পর্যন্ত ভাল রাখতেই তিনি ফরমালিন
মেশান। তার
যুক্তি,
ফরমালিন না মেশালে এই হাটে কেউ দুধের ব্যবসা করতে
পারবে না। সব
দুধ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে ফরমালিন মেশান।
তিনি আরও
জানান,
এই হাটে কিছু ব্যক্তি বোতলে ভরে ঘনমাত্রার ফরমালিন নিয়ে আসে। তাদের কাছ
থেকে আধা লিটার বোতল ফরমালিন কিনে নিয়ে যান। দুধ সংগ্রহের
পর
সামান্য পরিমাণ ঘনমাত্রার ফরমালিন মেশালেই
কাজ হয়। দুধ
বিক্রেতাদের যুক্তি, স্থানীয়ভাবে
দুধ সংগ্রহের পর পরই ফরমালিন না মেশালে দুধ নষ্ট হয়ে তাদের
ব্যবসার ক্ষতি হয়।
সম্প্রতি
খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে
বেশি আলোচিত হচ্ছে তার নাম ফরমালিন। সব ধরনের
খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা
বলছেন,
ফরমালিন এমন এক রাসায়নিক যা কখনই খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার
করা যায় না। শুধু
পচন রোধেই অসাধু ব্যবসায়ী এ রাসায়নিকটি ব্যবহার করে
সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছেন। শুধু দুধে নয়, মৌসুমী
ফলসহ মাছ-মাংস এবং অনান্য খাদ্যেও ফরমালিন
মেশানোর প্রবণতা রয়েছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য
ক্ষতিকর।
এ
তো গেল দুধে ফরমালিন মেশানোর গল্প। ফরমালিন ছাড়াও নানাভাবে
প্রতিনিয়ত খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। ভেজাল
মেশানোর সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীরা থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। একবার ধরা
পড়লে পরবর্তীতে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও একই প্রক্রিয়ায় ভেজাল মেশানোর সঙ্গে
জড়িত হয়ে পড়ছে। এসব
অপরাধী সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকলেও কেউ কেউ হাতেনাতেই
ধরা পড়েছে। দিয়েছে
ভেজাল মেশানোর সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। র্যাবের বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ
আদালত পরিচালনাকালে এবং সরেজমিনে পাওয়া গেছে ভেজাল
মেশানোর এসব ভয়াবহ চিত্র।
রাজধানীর কাওরানবাজারে
সুমন এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরাসহ
বিভিন্ন মসলা পেশানো বা ভাঙ্গানো। কিন্তু এ কারখানার বিরুদ্ধে ঘাসের
বীজের সঙ্গে রং মিশিয়ে ভেজাল গুঁড়ামসলা তৈরি কার্যক্রম হাতেনাতে ধরা পড়ে। এতে দেখা যায় ঘাসের বীজ বা কাউন
যা পাখির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা
ভেজাল মসলার মূল উপকরণ। ঘাসের বীজ গুঁড়া করে ক্ষতিকর রং মেশানো
হয়। এতে
লাল রং মেশালে তৈরি হয়ে যায় মরিচের গুঁড়া। আর হলুদ রং মেশালে একই গুঁড়া হয়ে
যাচ্ছে হলুদের। এর
সঙ্গে কিছু পচা কাঁচামরিচ শুকিয়ে দিলে মরিচের গুঁড়ায়
হালকা ঝাল হয়। আর
নকল হলুদের গুঁড়ায় কিছু আসল হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে দিলে
কেউ ভেজাল মসলা হিসেবে আর চিহ্নিত করতে পারে না।
ভেজাল গুঁড়া
মসলা তৈরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত গিয়াস উদ্দিন জানান, ১৫
বছর ধরে এ
প্রক্রিয়ায় তিনি ভেজাল মসলার গুঁড়া তৈরি করছেন। সাধারণত গভীর রাতে রং মেশানোর
কাজ করা হয়। তিনি
জানান এখান থেকে তৈরি ভেজাল গুঁড়া মসলার বেশিরভাগই
বিক্রি হয় ঢাকার সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। অধিক লাভের
আশায় বাইরের পার্টি এসে এখানে ভেজাল মসলার অর্ডার দেয়। আসল হলুদ ও মরিচের
গুঁড়া আড়াই শ’ টাকা কেজি হলেও ভেজাল এ মসলার
গুঁড়া মেলে ১৩০ টাকায়। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী
কাওরানবাজারের সব কারখানায় এভাবে এই ভেজাল দেয়া হয়। তাদের যুক্তি, মসলায়
ভেজাল না দিলে কারখানা চলবে না। কাস্টমার অন্যখানে চলে যাবে।
সুমন
এন্টারপ্রাইজের মালিক মনিরের স্বীকারোক্তি, তার
বাবা গনি মিয়া তাকে এই ভেজাল মসলার কাজ শিখিয়েছেন। এখন তিনি
নিজেই কর্মচারী দিয়ে এসব কাজ করান। তার বাবা গনি মিয়া বিক্রির কাজ করেন। সুমন জানান, গুঁড়া
মসলায় যে রং মেশানো হয় তা কাপড় তৈরির রং। কাওরানবাজারের
কিচেন মার্কেটের দোতলায় ৩শ’ টাকা কেজিতে
এসব রং পাওয়া যায়। অথচ
খাদ্যের পরিপূরক হিসেবে যে রং ব্যবহার করা হয় তার দাম ৫ হাজার টাকা কেজি।
খোঁজ
নিয়ে জানা গেছে, কাওরানবাজারের একাধিক
কারখানায় কয়েক বছর ধরেই এসব ব্যবসায়ী ভেজাল মসলা তৈরির কাজ করছেন। মাঝে মধ্যে
অভিযানে তারা ধরা পড়লে জরিমানা দিয়ে আবার একই কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে
পড়ছেন বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এএইমএম আনোয়ার পাশা।
ভেজাল ঘি
যেভাবে তৈরি হচ্ছে ॥ খাবার সুস্বাদু করতে ঘিয়ের জুড়ি মেলা
ভার। বাজারে মিল্ক
ভিটা,
আড়ং, রেডকাউ, প্রাণ
ও বাঘাবাড়ি প্রভৃতি ব্র্যান্ডের ঘি কিনতে পাওয়
যায়। কিন্তু
এসব ব্র্যান্ডের নামে যে নিম্নমানের ঘি বাজারে রয়েছে যা সম্পূর্ণ
ভেজাল প্রক্রিয়ায় তৈরি। কিন্তু ক্রেতা এসবের কোন খোঁজখবর রাখে
না
বললেই চলে। অথচ আসল ব্র্যান্ডের নামে ভেজাল মিশ্রিত
হয়ে ও নকল হয়ে তা বাজারে আসছে তা নিজ চোখে না
দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। রাজধানীর পুরান ঢাকা, কাওরানবাজারসহ
প্রভৃতি জায়গায় রয়েছে ভেজাল ঘি তৈরি কারখানা।
ভেজাল বিরোধী
আদালত কয়েকবার অভিযান চালিয়ে রাজধানীর চকবাজার ও লালবাগে সন্ধান পায়
এসব ঘি তৈরি কারখানা। লালবাগে এ রকম একটি কারখানায় ঘি তৈরি
করতেন
আব্দুস সামাদ মিয়া। পাম অয়েলের সঙ্গে ডালডা, কাপড়ের
রং মিশিয়ে তিনি তৈরি করেন ঘি। ঘির গন্ধ তৈরির জন্য সামান্য
পরিমাণ আসল ঘির ছাকা ব্যবহার করেন। তারা জানান, ঘি
তৈরির কারখানায় ফেলে দেয়া ছাকা দানা পাম অয়েলে ভিজিয়ে রাখলে ঘি
হালকা ঘ্রাণযুক্ত হয়। ঘি কারখানাগুলো ঘি তৈরির পর দানাদার
ছাকা বিনষ্ট করে কম দামে বিক্রি করে দেয়। এগুলো ভেজাল ঘি তৈরিতে ব্যবহার
করা হয়। আবার এই
ঘি তৈরি করা হয় অত্যন্ত নোংরা পরিবেশে। এরপর বাজারের ব্র্যান্ডের কৌটা সংগ্রহ
করে তার মুখ খুলে নতুন মুখ লাগিয়ে দেন। এভাবে তৈরি হয়ে যায় বাজারে মিল্ক
ভিটা,
আড়ং, রেডকাউ, প্রাণ
ও বাঘাবাড়ির ঘি।
শুধু রাজধানীর
লালবাগ বা চকবাজারে নয়, মতিঝিলের কিছু অভিজাত হোটেলেও এ
ধরনের
ভেজাল মিশিয়ে ঘি তৈরির প্রক্রিয়া হাতেনাতে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায় পাম তেল, বিষাক্ত
রং এবং ঘির সুগন্ধি মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে
বার বার অভিযান চালানোর পরও তারা তা অব্যাহত রেখেছেন। মতিঝিলে ভেজাল
ঘি তৈরি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মোঃ আব্দুল লালেক জানান, ভেজাল
ঘি
তৈরি করতে প্রতি কেজিতে খরচ হয় ১৫০ টাকা। অথচ পাইকারি দামে ৩শ’ টাকায়
তা
বিক্রি হয়। আর দোকানিরা বিক্রি করেন ৫ থেকে ৭শ’ টাকায়।
যেভাবে তৈরি
হয় সফট ড্রিংকস ॥ রাজধানীর
উত্তরখানের আটিপাড়ায় খান ফুড এ্যান্ড কেমিক্যাল
কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি
নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি করে সফট ড্রিংকস
পাউডার। ঘনচিনি
ও স্যাকারিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই সফট ড্রিংকস। অত্যন্ত
নোংরা পরিবেশে পাউডার বানিয়ে ড্রামে ভরে রাখা হয়। এগুলো পরে জমাট বেঁধে
গন্ধযুক্ত হয়। এর
মধ্যে চিনির গুঁড়া ও রং মিশিয়ে তৈরি করা হয় সফট ড্রিংকস। এর মধ্যে কমলার সেন্ট বা আমের
সেন্ট দিলে কমলা বা আমের ড্রিংসে পরিণত হয়।
গত
বছর রাজধানীর পশ্চিম কামরাঙ্গিরচরে হযরত নগরে
দোতলার বাড়ির নিচতলায় মোহাম্মাদ আলী ও তার শ্যালকের একটি কারখানায়
অভিযান চালানো হয়। তারা
সেখানে রঙিন কাঠি লজেন্স বা মৌসুমী লজেন্স নামের
একটি কারখানা গড়ে তোলেন। শিশুদের কাছে সব সময় আকর্ষণীয় এসব
লজেন্স। লজেন্সকে
শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করতে বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের রং ক্ষতিকর রং ব্যবহার
করে তৈরি করা হয়। এর
পর চকবাজারের মাধ্যমে সারাদেশে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে
দেয়া হয়। মোহাম্মদ
আলী জানান,
ছোটবেলায় তিনি লজেন্স তৈরির কারখানায় কাজ
শিখেছেন। নিম্নমানের
লিকুইড,
গ্লুকোজ, চিনি ফ্লেবার
ও ৬/৭ রকমের রং দিয়ে তৈরি মন্ড ছোট ছোট করে কেটে
হাত মেশিনে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের চকোলেট।
দেশের
খ্যাতনামা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ
এবিএম ইউনুস সম্প্রতি এক টিভি অনুষ্ঠানে মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি প্রসঙ্গে
ভেজাল খাদ্যের বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, খাবার
সংরক্ষণ করার জন্য যে ফরমালিন মাছ, ফল, সবজিতে
দেয়া হয় তা থেকে ক্যান্সার হতে পারে। তিনি বলেন, এই
ফরমালিন কীভাবে খাদ্যদ্রব্য প্রিজার্ভ করে: ফরমালিনে ডোবানোর সঙ্গে
সঙ্গে প্রোটিনগুলো ভেতরে ফিক্সড হয়ে গেলে তখন ওই
জিনিসটিতে সহজে আর পচন ধরবে না। আর ওই জিনিস খাওয়ার পর ফরমালিন
যখন আমাদের শরীরে যায়, ভেতরে গিয়ে
একেকটা জিনকে প্যারালাইজড করে দিতে পারে। তারপর আমরা আম- কলা
পাকার
জন্য কার্বাইড ব্যবহার করি। এগুলো কৃষিক্ষেত্রে ফার্টিলাইজার
কিংবা
কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা
দেহের ক্ষতি করে।
তিনি উদাহরণ
দিয়ে বলেন, আপনি
যদি ফুলকপি খেতে চান, সেটা
তো শীত মৌসুমের একটা সবজি। শীত
শুরু হওয়ার আগেই দেখলেন, বাজারে
ফুলকপি চলে এসেছে। পরিমাণটা বড় নয়, ছোট
ছোট। তবে অনেক দাম। কিন্তু
আপনার লোভ হলো এটি খাওয়ার। একটা
টমেটোর কথাই
ধরেন, যা
সময়ের আগে বাজারে এসেছে, সেটার
ভেতরে অত্যধিক কেমিক্যাল দেয়া হয়। এগুলো
খেলে অনেক সময় শরীরে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

No comments:
Post a Comment