১৫ থেকে ২৪
বছর বয়সী এ তরুণেরা শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণ
নিচ্ছেন না, চাকরিতেও
যোগ দিতে পারেননি
* আইএলওর প্রতিবেদন বলছে, এ অঞ্চলের ২১টি
দেশের মধ্যে খারাপ অবস্থার দিক দিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে
--------------------------------------------------------------------------
দেশের ১৫
থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ শিক্ষায় নেই, চাকরি করছেন না, আবার চাকরিতে যোগ
দেওয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছেন না। যদিও তাঁরা শ্রমবাজারেরই অংশ।
বিশ্বব্যাপী
তারুণ্যের এ ধরনের প্রবণতাকে নিষ্ক্রিয়তা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ধরনের তরুণদেরই একটি অংশ সমাজ
থেকে বিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে
থাকে বলে মনে করা হয়।
আন্তর্জাতিক
শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ডিসেন্ট
ওয়ার্ক ডিকেড: এশিয়া, প্যাসিফিক অ্যান্ড
দ্য আরব স্টেট’ শীর্ষক
একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা
হয়েছে, জনসংখ্যার
মধ্যে এ ধরনের তরুণদের হারের দিক দিয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়
অঞ্চলের ২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় খারাপ অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে কেবল মালদ্বীপ ও
ইয়েমেনে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার
বেশি। প্রতিবেশী
দেশ ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার অনেক কম।
নিষ্ক্রিয়
তরুণদের হারকে একটি সূচকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, যার নাম নিট। মানে হলো ‘নট ইন এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট, অর ট্রেনিং’। কোন দেশে কতসংখ্যক তরুণ
নিষ্ক্রিয়, তা
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, জাতিসংঘের টেকসই
উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসডিজির ৮ নম্বর লক্ষ্যটি হলো
শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক উন্নতি। এ লক্ষ্যের অধীনে ২০২০ সালের মধ্যে
নিষ্ক্রিয় তরুণের হার উল্লেখযোগ্য হারে
কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চাইলে
নিষ্ক্রিয় তরুণদের কর্মবাজারে নিয়ে আসতে হবে।
রিয়াদ হোসেন
তেমনই একজন তরুণ (১৯)। দুই বছর আগে এইচএসসি পাস করে এখন বরিশাল
থেকে ঢাকায় এসে চাকরির খোঁজ করছেন। শিল্পকারখানায় কাজ করার মতো কারিগরি
দক্ষতা তাঁর নেই। কায়িক
পরিশ্রমের কাজ করতে তিনি আগ্রহী নন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষায়
পড়াশোনা করে আসলে কোনো লাভ নেই। কোনো রকম লিখতে-পড়তে জানা আমার
বন্ধু বৈদ্যুতিক কাজ শিখে এখন একটি বড়
পোশাকের ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। বেতন ১৮ হাজার টাকা। আর আমি ৮-১০ হাজার টাকা বেতনেও
একটি চাকরি পাচ্ছি না।’
জানতে চাইলে
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম
আলোকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে যেটা
হয়, চাকরির
চেষ্টার ক্ষেত্রে অসফল হয়ে তরুণদের অনেকে
নির্বিকার হয়ে যান। এটি সামাজিক টাইম বোমার মতো কাজ করে। তিনি বলেন, এর ফলে বড় ধরনের
সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এটি যুবক শ্রেণিকে সামাজিক
বিচ্ছিন্নতাবোধ, বিপথে
গমন, সহিংসতায়
লিপ্ত হওয়া, মাদকাসক্তির
মতো বিপর্যয়ে উৎসাহিত করে।
ধনী দেশগুলোর
সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি)
ওয়েবসাইটে লেখা আছে, এ
ধরনের তরুণের মধ্যে যাঁরা
দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন এবং নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করার মতো দক্ষতা নেই, তাঁরা সমাজ থেকে
বিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
বিশ্বব্যাংকের
ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে প্রথম
আলোকে বলেন, সাধারণ শিক্ষা নিয়ে
বেরিয়ে যাওয়া তরুণদের অনেকে শ্রমবাজারে যুক্ত হতে পারেন না। ফলে তাঁরা বিপথে চলে যান। এটা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক অপচয়, অন্যদিকে এটা
সামাজিক ঝুঁকিরও সৃষ্টি করে। তাঁদের ভুল পথে নেওয়া দুষ্টচক্রের পক্ষে
অনেক সহজ হয়ে যায়। তিনি
বলেন, ‘আমরা
যে জনসংখ্যাগত সুবিধার
(ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) কথা বলি, এরাই
তো সেই সুবিধা। আমরা
সেই সুবিধার
অপচয় করছি।’
আইএলওর
আলোচ্য প্রতিবেদনটি ৬ থেকে ৯ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত
সংস্থাটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, গত এক দশকে এ অঞ্চলে
যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি
হয়েছে, তার
ভাগ এসব তরুণ পাননি। এ সময়ে শ্রমবাজারে তরুণ থাকা সহজ ছিল না।
আইএলওর
প্রতিবেদন বলছে, এ
অঞ্চলের ২১টি দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও
ভিয়েতনামে নিষ্ক্রিয়
তরুণের হার কম। অন্যদিকে
সবচেয়ে বেশি মালদ্বীপে (৫৬ %)। এর পরের অবস্থানে ইয়েমেন। এ দেশটিতে ৪৮ শতাংশ তরুণ
নিষ্ক্রিয়। প্রতিবেদনে
বলা হয়, অনেক
তরুণের শিক্ষা গ্রহণের সামর্থ্য না থাকায় তাঁরা পড়াশোনা ছেড়ে দেন। পরিবারও
তাঁদের সহায়তা করতে পারে না, বরং
পরিবারকে তাঁদের সহায়তা করতে হয়। ফলে
এসব তরুণ জীবিকার জন্য যা কাজ পান, তা-ই
করতে শুরু করেন। এ
কাজ সাধারণত অপ্রাতিষ্ঠানিক
হয়।
আইএলওর
প্রতিবেদনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তরুণদের বেকারত্বের
একটি চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে মোট বেকারের মধ্যে ৪০
শতাংশ তরুণ। তরুণদের
বেকারত্বের হার আরব দেশগুলোতে বেশি। দক্ষিণ
এশিয়ায় তুলনামূলক কম।
দেবপ্রিয়
ভট্টাচার্য বলেন, দেশে
অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর
যথোপযুক্ত না হওয়াতে, শিল্প
খাতের বিকাশ না ঘটাতে এই নবীন কর্মশক্তি
মজুরিভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে শোভন কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। তাদের
যে গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা পাওয়া দরকার,
তাতেও ঘাটতি আছে। তাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট পরিমাণে
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে না
এবং তা বাজারের চাহিদাও মেটায় না।
এর সমাধান কী, জানতে চাইলে
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শুরু করতে হবে শিক্ষা
থেকে। শিক্ষার
গুণগত মান, শিক্ষকের
মান ও অবকাঠামো বাড়াতে হবে। চাকরি করার চেয়ে তাদের উদ্যোক্তা
করার চেষ্টা করতে হবে। অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
জাহিদ হোসেনও
শিক্ষার মানের সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাজারের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে এ তরুণ
জনগোষ্ঠীর দক্ষতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি
বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

No comments:
Post a Comment