HONS. COMPULSORY ENGLISH

Search This Blog

Sunday, January 29, 2017

গরুর দুধ বিক্রি করে পড়েছি-অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান-সৌজন্যে ড্যাফোডিল ইংলিশ কোচিং, দৌলতপুর খুলনা—০১৭১৭-০৮৭১৯৯/০১৯১৭-৪৬১৬০৫




একটা গাভী আর কয়েকটা খাসি আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওগুলো মাঠে চরাতামবিকেল বেলা গাভীর দুধ নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করতামদুধ বিক্রির আয় থেকে সঞ্চিত আট টাকা দিয়ে আমি পান-বিড়ির দোকান দেই
অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান-বাংলাদেশ ব্যংক গভর্নর
আমার জন্ম জামালপুর জেলার এক অজপাড়াগাঁয়ে১৪ কিলোমিটার দূরের শহরে যেতে হতো পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে চড়েপুরো গ্রামের মধ্যে একমাত্র মেট্রিক পাস ছিলেন আমার চাচা মফিজউদ্দিনআমার বাবা একজন অতি দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক আমরা পাঁচ ভাই, তিন বোনকোনরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতো আমাদের
আমার দাদার আর্থিক অবস্থা ছিলো মোটামুটিকিন্তু তিনি আমার বাবাকে তাঁর বাড়িতে ঠাঁই দেননিদাদার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা ছনের ঘরে আমরা এতগুলো ভাই-বোন আর বাবা-মা থাকতামমা তাঁর বাবার বাড়ি থেকে নানার সম্পত্তির সামান্য অংশ পেয়েছিলেনতাতে তিন বিঘা জমি কেনা হয়চাষাবাদের জন্য অনুপযুক্ত ওই জমিতে বহু কষ্টে বাবা যা ফলাতেন, তাতে বছরে ৫/৬ মাসের খাবার জুটতোদারিদ্র্য কী জিনিস, তা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি- খাবার নেই, পরনের কাপড় নেই; কী এক অবস্থা !
আমার মা সামান্য লেখাপড়া জানতেনতাঁর কাছেই আমার পড়াশোনার হাতেখড়িতারপর বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হইকিন্তু আমার পরিবারে এতটাই অভাব যে, আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলাম, তখন আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলো নাবড় ভাই আরো আগে স্কুল ছেড়ে কাজে ঢুকেছেনআমাকেও লেখাপড়া ছেড়ে রোজগারের পথে নামতে হলো
আমাদের একটা গাভী আর কয়েকটা খাসি ছিলআমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওগুলো মাঠে চরাতামবিকেল বেলা গাভীর দুধ নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করতামএভাবে দুই ভাই মিলে যা আয় করতাম, তাতে কোনরকমে দিন কাটছিলকিছুদিন চলার পর দুধ বিক্রির আয় থেকে সঞ্চিত আট টাকা দিয়ে আমি পান-বিড়ির দোকান দেইপ্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে বসতাম পড়াশোনা তো বন্ধই, আদৌ করবো- সেই স্বপ্নও ছিল না !
এক বিকেলে বড় ভাই বললেন, আজ স্কুল মাঠে নাটক হবেস্পষ্ট মনে আছে, তখন আমার গায়ে দেওয়ার মতো কোন জামা নেইখালি গা আর লুঙ্গি পরে আমি ভাইয়ের সঙ্গে নাটক দেখতে চলেছিস্কুলে পৌঁছে আমি তো বিস্ময়ে হতবাক ! চারদিকে এত আনন্দময় চমৎকার পরিবেশ ! আমার মনে হলো, আমিও তো আর সবার মতোই হতে পারতামসিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে আবার স্কুলে ফিরে আসতে হবে
নাটক দেখে বাড়ি ফেরার পথে বড় ভাইকে বললাম, আমি কি আবার স্কুলে ফিরে আসতে পারি না ? আমার বলার ভঙ্গি বা করুণ চাহনি দেখেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক কথাটা ভাইয়ের মনে ধরলোতিনি বললেন, ঠিক আছে কাল হেডস্যারের সঙ্গে আলাপ করবো
পরদিন দুই ভাই আবার স্কুলে গেলামবড় ভাই আমাকে হেডস্যারের রুমের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গেলেনআমি বাইরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনছি, ভাই বলছেন আমাকে যেন বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগটুকু দেওয়া হয় কিন্তু হেডস্যার অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললেন, সবাইকে দিয়ে কি লেখাপড়া হয় ! স্যারের কথা শুনে আমার মাথা নিচু হয়ে গেলযতখানি আশা নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলাম, স্যারের এক কথাতেই সব ধুলিস্মাৎ হয়ে গেলতবু বড় ভাই অনেক পীড়াপীড়ি করে আমার পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি যোগাড় করলেনপরীক্ষার তখন আর মাত্র তিন মাস বাকিবাড়ি ফিরে মাকে বললাম, আমাকে তিন মাসের ছুটি দিতে হবেআমি আর এখানে থাকবো নাকারণ ঘরে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই- আমার কোন বইও নেই, কিন্তু আমাকে পরীক্ষায় পাস করতে হবে
মা বললেন, কোথায় যাবি ? বললাম, আমার এককালের সহপাঠী এবং এখন ক্লাসের ফার্স্টবয় মোজাম্মেলের বাড়িতে যাবোওর মায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আছেযে কদিন কথা বলেছি, তাতে করে খুব ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছেআমার বিশ্বাস, আমাকে উনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন না
দুরু দুরু মনে মোজাম্মেলের বাড়ি গেলামসবকিছু খুলে বলতেই খালাম্মা সানন্দে রাজি হলেনআমার খাবার আর আশ্রয় জুটলো; শুরু হলো নতুন জীবননতুন করে পড়াশোনা শুরু করলামপ্রতিক্ষণেই হেডস্যারের সেই অবজ্ঞাসূচক কথা মনে পড়ে যায়, জেদ কাজ করে মনে; আরো ভালো করে পড়াশোনা করি
যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হলোআমি এক-একটি পরীক্ষা শেষ করছি আর ক্রমেই যেন উজ্জীবিত হচ্ছিআমার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যাচ্ছেফল প্রকাশের দিন আমি স্কুলে গিয়ে প্রথম সারিতে বসলামহেডস্যার ফলাফল নিয়ে এলেনআমি লক্ষ্য করলাম, পড়তে গিয়ে তিনি কেমন যেন দ্বিধান্বিতআড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেনতারপর ফল ঘোষণা করলেনআমি প্রথম হয়েছি ! খবর শুনে বড় ভাই আনন্দে কেঁদে ফেললেনশুধু আমি নির্বিকার- যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল
বাড়ি ফেরার পথে সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যআমি আর আমার ভাই গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছিআর পিছনে এক দল ছেলেমেয়ে আমাকে নিয়ে হৈ চৈ করছে, স্লোগান দিচ্ছেসারা গাঁয়ে সাড়া পড়ে গেল ! আমার নিরক্ষর বাবা, যাঁর কাছে ফার্স্ট আর লাস্ট একই কথা- তিনিও আনন্দে আত্মহারা; শুধু এইটুকু বুঝলেন যে, ছেলে বিশেষ কিছু একটা করেছেযখন শুনলেন আমি ওপরের কাসে উঠেছি, নতুন বই লাগবে, পরদিনই ঘরের খাসিটা হাটে নিয়ে গিয়ে ১২ টাকায় বিক্রি করে দিলেন তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে জামালপুর গেলেনসেখানকার নবনূর লাইব্রেরি থেকে নতুন বই কিনলাম
আমার জীবনযাত্রা এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছেআমি রোজ স্কুলে যাইঅবসরে সংসারের কাজ করিইতোমধ্যে স্যারদের সুনজরে পড়ে গেছি ফয়েজ মৌলভী স্যার আমাকে তাঁর সন্তানের মতো দেখাশুনা করতে লাগলেনসবার আদর, যত্ন, স্নেহে আমি ফার্স্ট হয়েই পঞ্চম শ্রেণীতে উঠলামএতদিনে গ্রামের একমাত্র মেট্রিক পাস মফিজউদ্দিন চাচা আমার খোঁজ নিলেনতাঁর বাড়িতে আমার আশ্রয় জুটলো
প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে আমি দিঘপাইত জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হইচাচা ওই স্কুলের শিক্ষকঅন্য শিক্ষকরাও আমার সংগ্রামের কথা জানতেনতাই সবার বাড়তি আদর-ভালোবাসা পেতাম
আমি যখন সপ্তম শ্রেণী পেরিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে উঠবো, তখন চাচা একদিন কোত্থেকে যেন একটা বিজ্ঞাপন কেটে নিয়ে এসে আমাকে দেখালেনওইটা ছিল ক্যাডেট কলেজে ভর্তির বিজ্ঞাপনযথাসময়ে ফরম পুরণ করে পাঠালামএখানে বলা দরকার, আমার নাম ছিল আতাউর রহমানকিন্তু ক্যাডেট কলেজের ভর্তি ফরমে স্কুলের হেডস্যার আমার নাম আতিউর রহমান লিখে চাচাকে বলেছিলেন, এই ছেলে একদিন অনেক বড় কিছু হবেদেশে অনেক আতাউর আছেওর নামটা একটু আলাদা হওয়া দরকার; তাই আতিউর করে দিলাম
আমি রাত জেগে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিলামনির্ধারিত দিনে চাচার সঙ্গে পরীক্ষা দিতে রওনা হলামওই আমার জীবনে প্রথম ময়মনসিংহ যাওয়াগিয়ে সবকিছু দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ ! এত এত ছেলের মধ্যে আমিই কেবল পায়জামা আর স্পঞ্জ পরে এসেছি ! আমার মনে হলো, না আসাটাই ভালো ছিলঅহেতুক কষ্ট করলামযাই হোক পরীক্ষা দিলাম; ভাবলাম হবে নাকিন্তু দুই মাস পর চিঠি পেলাম, আমি নির্বাচিত হয়েছিএখন চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে
সবাই খুব খুশি; কেবল আমিই হতাশআমার একটা প্যান্ট নেই, যেটা পরে যাবোশেষে স্কুলের কেরানি কানাই লাল বিশ্বাসের ফুলপ্যান্টটা ধার করলামআর একটা শার্ট যোগাড় হলোআমি আর চাচা অচেনা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলামচাচা শিখিয়ে দিলেন, মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে আমি যেন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলি: ম্যা আই কাম ইন স্যার ? ঠিকমতোই বললাম তবে এত উচ্চস্বরে বললাম যে, উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলো
পরীক্ষকদের একজন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ এম. ডাব্লিউ. পিট আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে সবকিছু আঁচ করে ফেললেনপরম স্নেহে তিনি আমাকে বসালেনমুহূর্তের মধ্যে তিনি আমার খুব আপন হয়ে গেলেনআমার মনে হলো, তিনি থাকলে আমার কোন ভয় নেইপিট স্যার আমার লিখিত পরীক্ষার খাতায় চোখ বুলিয়ে নিলেনতারপর অন্য পরীক্ষকদের সঙ্গে ইংরেজিতে কী-সব আলাপ করলেন আমি সবটা না বুঝলেও আঁচ করতে পারলাম যে, আমাকে তাঁদের পছন্দ হয়েছেতবে তাঁরা কিছুই বললেন নাপরদিন ঢাকা শহর ঘুরে দেখে বাড়ি ফিরে এলামযথারীতি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলামকারণ আমি ধরেই নিয়েছি, আমার চান্স হবে না
হঠাৎ তিন মাস পর চিঠি এলোআমি চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছিমাসে ১৫০ টাকা বেতন লাগবেএর মধ্যে ১০০ টাকা বৃত্তি দেওয়া হবে, বাকি ৫০ টাকা আমার পরিবারকে যোগান দিতে হবেচিঠি পড়ে মন ভেঙে গেলযেখানে আমার পরিবারের তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, আমি চাচার বাড়িতে মানুষ হচ্ছি, সেখানে প্রতিমাসে ৫০ টাকা বেতন যোগানোর কথা চিন্তাও করা যায় না !
এই যখন অবস্থা, তখন প্রথমবারের মতো আমার দাদা সরব হলেনএত বছর পর নাতির (আমার) খোঁজ নিলেনআমাকে অন্য চাচাদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা থাকতে নাতি আমার এত ভালো সুযোগ পেয়েও পড়তে পারবে না ? কিন্তু তাঁদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল নাতাঁরা বললেন, একবার না হয় ৫০ টাকা যোগাড় করে দেবো, কিন্তু প্রতি মাসে তো সম্ভব নয়দাদাও বিষয়টা বুঝলেন
আমি আর কোন আশার আলো দেখতে না পেয়ে সেই ফয়েজ মৌলভী স্যারের কাছে গেলামতিনি বললেন, আমি থাকতে কোন চিন্তা করবে নাপরদিন আরো দুইজন সহকর্মী আর আমাকে নিয়ে তিনি হাটে গেলেনসেখানে গামছা পেতে দোকানে দোকানে ঘুরলেনসবাইকে বিস্তারিত বলে সাহায্য চাইলেনসবাই সাধ্য মতো আট আনা, চার আনা, এক টাকা, দুই টাকা দিলেনসব মিলিয়ে ১৫০ টাকা হলোআর চাচারা দিলেন ৫০ টাকাএই সামান্য টাকা সম্বল করে আমি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলামযাতায়াত খরচ বাদ দিয়ে আমি ১৫০ টাকায় তিন মাসের বেতন পরিশোধ করলামশুরু হলো অন্য এক জীবন
প্রথম দিনেই এম. ডাব্লিউ. পিট স্যার আমাকে দেখতে এলেনআমি সবকিছু খুলে বললামআরো জানালাম যে, যেহেতু আমার আর বেতন দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাই তিন মাস পর ক্যাডেট কলেজ ছেড়ে চলে যেতে হবেসব শুনে স্যার আমার বিষয়টা বোর্ড মিটিঙে তুললেন এবং পুরো ১৫০ টাকাই বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিলেনসেই থেকে আমাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নিএস.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে পঞ্চম স্থান অধিকার করলাম এবং আরো অনেক সাফল্যের মুকুট যোগ হলো
আমার জীবনটা সাধারণ মানুষের অনুদানে ভরপুরপরবর্তীকালে আমি আমার এলাকায় স্কুল করেছি, কলেজ করেছিযখন যাকে যতটা পারি, সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতাও করিকিন্তু সেই যে হাট থেকে তোলা ১৫০ টাকা; সেই ঋণ আজও শোধ হয়নিআমার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করলেও সেই ঋণ শোধ হবে না!
(অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের নিজের ভাষায় তাঁর জীবন কথা

No comments:

Post a Comment